জার্মানীর হামবুর্গে যাবার পথে দুবাই বিমানবন্দরের ট্রানজিটেই দেখা হয়ে গেল সাঈদ নাজাকাতের সঙ্গে। তিনি ডেটালিডসের প্রধান নির্বাহী এবং গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম নেটওয়ার্কের পরিচালনা পর্ষদ সদস্য। “এবার তো সম্মেলন যতটা ‘গ্লোবাল’ তার চেয়ে অনেক বেশি ‘এশিয়ান’ মনে হচ্ছে! এত এশীয় সাংবাদিক এর আগে কোনো সম্মেলনে দেখিনি।” বিমানবন্দরে বাংলাদেশের আট অংশগ্রহনকারীকে এক সাথে দেখে উচ্ছাসের সাথে একথা বললেন নাজাকাত।
সত্যিই তাই। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা তো আছেই, তার সাথে গোটা মধ্যপ্রাচ্য, হংকং, জাপান, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, এমনকি মোঙ্গোলিয়া থেকে যত সাংবাদিক এসেছেন, তা রীতিমত অবাক করা। এমনি এই অঞ্চলে সাংবাদিকতা দিনে দিনে কঠিন হয়ে উঠছে। তার মধ্যে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার এই জমায়েতে এমন উপস্থিতি, যেন এটাই জানান দিয়ে গেছে, “আমরা একা নই, আমরা এখনো হাল ছাড়িনি।”
১৩০টি দেশ থেকে এবার প্রায় ১৭০০ সাংবাদিক যোগ দিয়েছেন একাদশ গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সে। তাদের কেউ ক্যারিয়ার মাত্র শুরু করেছেন, কেউ বড় অনুসন্ধানে হাত দিয়েছেন, আবার কেউবা এরিমধ্যে এক বা একাধিক পুলিৎজার পুরস্কার ঝুলিতে পুরেছেন। তাদের কেউ একটি সেশনে বক্তা, তিনিই আবার অন্য সেশনে পুরোদমে মাটিতে বা চেয়ারে বসে অন্যদের কাছে শিখছেন। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এটাই ছিল “স্পিরিট”।
সেপ্টেম্বরের ২৬ থেকে ২৯ তারিখ, একটানা চার দিন ধরে প্রায় আড়াইশ সেশনে অংশগ্রহণকারীরা কখনো শংকার কথা শুনেছেন, কখনো আশায় বুক বেঁধেছেন, অনুসন্ধানী নানা টুল, প্রযুক্তি ও কৌশলের কথা জেনেছেন, কোলাবরেশন তথা জোটবেঁধে নতুন অনুসন্ধানের পরিকল্পনায় নেমেছেন, আর নতুন নতুন মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়েছেন। এভাবে সাংবাদিকদের নেটওয়ার্কটাও আরো বৈশ্বিক হয়ে উঠেছে। মাত্র চার দিনে!
শংকা ও আশাবাদ
সাংবাদিকতার জন্য গোটা বিশ্বই যে কঠিন হয়ে উঠছে, তা মোটাদাগে এবার সবার কন্ঠেই উঠে এসেছে। এই শংকার সাথে আশাবাদও ছিল। “স্বৈরশাসকরা ভাবছেন আমরা চলে যাবো। কিন্তু আমরা যাচ্ছি না। বরং লড়াইটা আরো জমবে। এখন আরো অনেক বেশী অনুসন্ধানী সাংবাদিক আসছেন, তারা আরো উন্নত টুল ব্যবহার করছেন। তৈরি হচ্ছে নতুন এক প্রজন্ম যারা আমাদের চেয়ে ভালো। এই সম্মেলন সেটাই বলছে,” প্রথম দিনের উদ্বোধনী অধিবেশনে এমনটাই বলেছেন জিআইজেএনের নির্বাহী পরিচালক ডেভিড কাপলান।
প্লেনারি সেশনটি ছিল সামনের দিনের চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে। সেখানে কেউ বলেছেন, রাষ্ট্রীয় নজরদারির বাড়তে থাকা পরিধির কথা, কেউ বলেছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কীভাবে জায়গা নেবে সাংবাদিকতায়, কেউবা বলেছেন উগ্রজাতীয়তাবাদের এই যুগে তথ্য-প্রমাণকে অস্বীকার করার প্রবণতা – নতুন ঝুঁকি তৈরি করবে। কিন্তু অনুসন্ধানী গণমাধ্যম অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট, ওসিসিআরপির সম্পাদক ড্রিউ সুলিভান বলছেন, সাংবাদিকরাও জবাব দিতে তৈরি। তার বক্তব্য হল, “আগামী ৩ থেকে ৫ বছরে আমরা এমন কিছু পরিবর্তন দেখতে পাবো, যা আগামী ২০ বছরের জন্য বিশ্বের সাংবাদিকতাকে বদলে দেবে। সেখানে কোলাবরেশন থাকবে, থাকবে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, এমন অনেক কিছুই।”
শুরু থেকে যদি চলে যাই একেবারে বিদায়ী অধিবেশনে, সেখানেও একই সুর। এবার স্মারক বক্তব্য রেখেছেন ফিলিপাইনের জনপ্রিয় গণমাধ্যম র্যাপলারের সম্পাদক মারিয়া রেসা। দফায় দফায় মামলা দিয়ে, আটক করে, তাকে হয়রানি করছে দেশটির সরকার। বিরূপ এই বর্তমানে দাঁড়িয়ে, তিনি ভবিষ্যতে আরো কঠিন লড়াইয়ের ইঙ্গিত দিয়েছেন। বলেছেন, “নিউজরুমগুলোর জন্ম হয়েছে প্রতিযোগিতা করার জন্য। কিন্তু আমরা বুঝতে পারছি না, প্রতিযেগিতাটা এখন আর একে অপরের সঙ্গে নয়। আমরা প্রতিযোগিতা করছি ভূয়া তথ্য ছড়ানোর নেটওয়ার্কগুলোর সঙ্গে। আমাদের প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে সত্য ঘটনা বলার জন্যে।”
আবেগজড়িত এই বক্তব্যে রেসা যেই বার্তাটা দিতে চেয়েছেন, তা পুরোপুরি উপলব্ধি করতে হলে আপনাকে অবশ্যই শুনতে হবে ওপরের ভিডিওটি। যা কিনা অনেকের কাছেই চার দিনের সম্মেলনে সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছিল।
নতুন টুল, নতুন কৌশল
এই সম্মেলনে কি শুধু কথাই হয়। মোটেও তা নয়। অনেক টাকা খরচ করে এখানে সাংবাদিকরা আসেন মূলত শিখতে। দিনে গড়ে ৫০টির বেশি সেশনের কথা বলে শেষ করা যাবে না। কিন্তু এই অঞ্চলের জন্য প্রাসঙ্গিক কয়েকটি সেশনের কথা না বললেই নয়। অনলাইন রিসার্চে বিবিসির পল মায়ার্সের সেশন এবারও ছিল সুপারহিট। যথারীতি রুম ভরে যাওয়ায় দরজা বন্ধ করে দিতে হয়েছিল জাহাজ ও সাপ্লাই চেইন ট্র্যাকিং, ক্রিমিনাল সার্ভিসেস ইন্ডাস্ট্রি, দুর্নীতি ও আর্থিক অনিয়ম অনুসন্ধান, ভুয়া তথ্য যাচাই আর ডেটা সাংবাদিকতার হাতেকলমের সেশনগুলোতে।
বাংলাভাষী সাংবাদিকদের সবচেয়ে বেশি প্রশংসা করতে শোনা গেছে “দ্য চেঞ্জিং আর্ট অব স্টোরিটেলিং” নামের সেশনটি নিয়ে। কীভাবে বদলে যাচ্ছে গল্প বলার প্রথাগত ধরন, কীভাবে সাধারণ মেসেজ, ডেটা অথবা অ্যনিমেশন দিয়ে তুলে ধরা হচ্ছে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন – এমন নানা নীরিক্ষা তুলে ধরেছিলেন সেশনের তিন বক্তা এরলেন্ড আর্নস্টেন, সুজান রিবার এবং ফিলিপ ফেইগেল।
'Show more, tell less. & tell your story in the present tense' — marie caloz, Senior Director Investigative, @CBCNews #GIJC19 #gijnbangla pic.twitter.com/FBhGr95Som
— Saurav Rahman (@rahman_saurav) September 27, 2019
বাংলাদেশ বা ভারতের সাংবাদিকদের কাছে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল জলবায়ূ পরিবর্তন। এ নিয়ে একাধিক সেশন ছিল। কীভাবে জলবায়ূ পরিবর্তনের মত বিষয়কে একের পর এক প্রমাণ দিয়ে নথিবদ্ধ করতে হয়, দাবানল থেকে শুরু করে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে হিমবাহ গলে যাওয়া পর্যন্ত নানা বিষয়ে অনুসন্ধানের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এসব সেশনে তুলে ধরেন সাংবাদিকরা।
আরেকটি পছন্দের সেশন ছিল অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় স্যাটেলাইট ছবির ব্যবহার। সম্মেলনের তৃতীয় দিনে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করতে বাংলাভাষী সাংবাদিকদের সাথে আলাদা করে বসেছিলেন অনূসূয়া দত্ত। তিনিও বাঙ্গালী। এখন কাজ করছেন জিওস্পেশিয়াল মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানে নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে। শুধু এই সেশনের জন্য তিনি বাংলাদেশে নদীর গতিপথ পরিবর্তনের একটি জিআইএফ বানিয়ে দেখালেন, কীভাবে স্যাটেলাইট ছবি পরিবেশ বিপর্যয়, বন দখল, নগরায়ন এবং বায়ূ দূষণের মত বিষয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে কাজে আসতে পারে।
এর বাইরেও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা উন্নয়নের কার্যকর মডেল, বিরূপ পরিবেশে সাংবাদিকতা করেও কীভাবে টিকে থাকা যায়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যুগে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কীভাবে করা যায় – এমন সব বিষয়ে বক্তা হিসেবে অংশ নেন দৈনিক ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামসহ বাংলাদেশী ও বাংলাভাষী সাংবাদিকরা।
কোলাবরেশন: সীমান্ত ছাড়িয়ে অনুসন্ধান
ফিরে আসা যাক, সেই সাঈদ নাজাকাতের কথায়। যিনি এবার এশিয়ার সাংবাদিকদের সরব উপস্থিতিতে মুগ্ধ ছিলেন। হংকংভিত্তিক আরেক সাংবাদিক শেরি লি-কে সাথে নিয়ে তিনি সঞ্চালনা করছিলেন “বিল্ডিং এশিয়ান ইনভেস্টিগেটিভ নেটওয়ার্কস” নামের একটি সেশন। তার মুগ্ধতাকে সত্য প্রমাণ করতেই যেন, হলরুমটি ছিল সাংবাদিকে ভরা।
#Sherry Lee and @SyedNazakat on building Asian networks #GIJC19 @gijn pic.twitter.com/oBPP2KXTB0
— CIJ-India (@CijIndia) September 28, 2019
একে একে সেখানে তুলে ধরা হয় কোলাবরেটিভ সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা। কয়েকটি দেশের সাংবাদিক মিলে কীভাবে উদঘাটন করেছেন বিপন্নপ্রায় প্রাণী প্যানগোলিন পাচার, কীভাবে শ্রম অভিবাসন নিয়ে যৌথ অনুসন্ধান করেছে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার দুটি দৈনিক, আর কত কত ক্ষেত্র আছে যেখানে এশিয়ার সাংবাদিকরা জোটবদ্ধ হয়ে উন্মোচন করতে পারেন সবার জন্য প্রাসঙ্গিক কোন ইস্যু – সোয়া এক ঘন্টা ধরে এমন আলোচনাই চলতে থাকে সেখানে।
কোলাবরেশন বা সহযোগিতা শব্দটি ছিল সম্মেলনের প্রধান গুঞ্জন। কোনো আন্তঃসীমান্ত অপরাধের অনুসন্ধান করতে গিয়ে আপনার হয়তো অন্য কোনো দেশের সাংবাদিকের সহযোগিতা দরকার। এখান থেকে সেই সহযোগী-বন্ধু-সহকর্মী খুঁজেছেন ও জোট বেঁধেছেন বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা। জিআইজেএন বাংলার ফেইসবুক আলোচনাতেও বিষয়টি সামনে এনেছেন বাংলাদেশ ও ভারতের দুই সম্পাদক। তাগিদ দিয়েছেন, দুই দেশের সাংবাদিকদের মধ্যে সহযোগিতার।
দক্ষিণ এশিয়ায় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা: আমরা কোথায় আছি? হামবুর্গ থেকে সরাসরি দেখুন GIJN বাংলার ফেসবুক পাতায়। আলোচনায় আছেন মিরাজ আহমেদ চৌধুরী, আসফাক হক ও মানু পাবি (ভারত)।
Posted by GIJN বাংলা – Global Investigative Journalism Network on Thursday, September 26, 2019
শেষ তবু শেষ নয়
অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের এই সম্মেলন শেষ হয়েও শেষ হয় না। অনেক দিন তার রেশ থেকে যায়। এখান থেকে শুরু হয় নতুন নতুন অনুসন্ধান। এখান থেকে শেখা টুল বা কৌশল সাংবাদিকরা ব্যবহার করেন তাদের নতুন প্রতিবেদনে। এখানকার জ্ঞানগুলো থেকে যায় সাংবাদিকদের মাথায়, মনে। অনেকেই ফিরে যান আরো সাহস ও অনুপ্রেরণা নিয়ে, যা তাদের শেখায় অন্য দেশে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও যদি বড় বড় অনুসন্ধান করা যায়, তবে কেন নিজ দেশে নয়।
অনেকেরই হয়তো জানা নেই কিছু জ্ঞান স্থায়ীভাবে রয়ে গেছে সম্মেলনের ওয়েবসাইটেও! যারা গিয়েছেন তো গিয়েছেনই, যারা যাননি তাদের জন্যেও অন্তত ৮৫টি রিসোর্স, টিপশীট আর প্রেজেন্টেশন পাওয়া যাবে এই ওয়েবসাইটে। আগ্রহী হলে ভিজিট করতে পারেন টিপশীট পেইজটি। এর বাইরে কোন সেশনে কী হলো, তা নিয়ে অন্তত ৪৫টি লেখা এরিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে, যা আরো অনেকদিন ধরেই আপনার সাংবাদিকতাকে শক্তি যোগাবে, আপনার জন্য নতুন কৌশলের উৎস হয়ে থাকবে। এর বাইরে গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু সেশনে অভিজ্ঞ সাংবাদিকরা যেসব পরামর্শ দিয়েছেন তার ভিডিও আছে জিআইজেএনের ইনস্টাগ্রাম এবং ইউটিউব চ্যানেলে।
আর যেতে যেতে দেখে নিন এবারের সম্মেলন নিয়ে তৈরি ছোট এই ভিডিওটি।
মিরাজ আহমেদ চৌধুরী, জিআইজেএনের বাংলা সম্পাদক। এর পাশাপাশি তিনি গণমাধ্যম উন্নয়ন সংস্থা এমআরডিআইয়ের হেড অব প্রোগ্রাম অ্যান্ড কমিউনিকেশনস হিসেবে কাজ করছেন। সাংবাদিকতায় তার রয়েছে ১৪ বছরের অভিজ্ঞতা, যার বড় অংশই টেলিভিশনে।